মঙ্গল পান্ডে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? মঙ্গল পান্ডে কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও মঙ্গল পান্ডে সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Mangal Pandey in Bengali)।
মঙ্গল পান্ডে, যিনি ছিলেন ভারতীয় একজন সৈনিক ১৮৫৭ সালের ভারতীয় সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা তে মূল ভূমিকা পালনকারী ছিলেন। এই সিপাহী মঙ্গল পান্ডে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৩৪ তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি (BNI) সৈন্যদলের সিপাহী ছিলেন।
সেই সময় ব্রিটিশ মতামত তাকে বিশ্বাসঘাতক এবং বিদ্রোহী হিসেবে নিন্দা করলেও মঙ্গল পান্ডে আধুনিক ভারতের একজন নায়ক ছিলেন। এরপর ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার তার শ্রদ্ধা জানাতে এবং স্মরণ করে রাখার জন্য ডাকটিক জারি করেছিল। একাধিক চলচ্চিত্রে তার জীবন এবং ক্রিয়াকলাপ অভিনীত হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভিন্ন বিপ্লবীদের নামের মধ্যে মঙ্গল পান্ডের নামটাও কিন্তু খুবই সুন্দরভাবে জড়িত। ছোট থেকে বড় সকলেই জানেন যে, এই মঙ্গল পান্ডে দেশের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, এমনই একজন বিপ্লবী মঙ্গল পান্ডের জীবনী সম্পর্কে:
মঙ্গল পান্ডের জীবনী:
- নাম: মঙ্গল পান্ডে
- ডাক নাম: মঙ্গল
- জন্ম তারিখ: ১৯ শে জুলাই ১৮২৭, নাগওয়া, বালিয়া জেলা, সমর্পিত ও বিজিত প্রদেশ সমূহ, মুঘল সাম্রাজ্য
- পিতার নাম: দিবাকর পান্ডে
- সার্ভিস অথবা শাখা: বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি
- পদমর্যাদা: তিনি সিপাহী ছিলেন
- তার মৃত্যু: ৮ ই এপ্রিল ১৮৫৭ সাল
- বয়স: বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর ব্যারাকপুর কলকাতা বেঙ্গল প্রদেশ ব্রিটিশ ভারত
মঙ্গল পান্ডের জন্ম ও শৈশব জীবন:
মঙ্গল পান্ডে ১৮২৭ সালের ১৯ শে জুলাই তখনকার সময়ে সমর্পিত ও বিজিত প্রদেশের, বর্তমান যেটা উত্তর প্রদেশে অবস্থিত উচ্চ বালিয়া জেলার, নাগওয়া গ্রামের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৮৪৯ সালে বেঙ্গল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে মঙ্গল পান্ডে ৩৪ তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রী এর পঞ্চম কোম্পানির একজন বেসরকারি সৈনিক ছিলেন।
মঙ্গল পান্ডের পিতার নাম ছিল দিবাকর পান্ডে। তিনি ছিলেন পেশাতে একজন কৃষক। মঙ্গল পান্ডের একটি বোন ও ছিল, সেই বোনটির ১৮৩০ সালে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে অকাল মৃত্যু ঘটে।
মঙ্গল পান্ডের শিক্ষা জীবন:
মঙ্গল পান্ডের পড়াশোনার হাতে খড়ি হয়েছিল নিজের পরিবারেই। তবে পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অভাবের কারণে কোনোরকমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেছিলেন তিনি। সংসার ছিল খুবই অভাবের, তাই আগে আর পড়াশোনা করতে পারেন নি।
এরপর দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত মঙ্গল পান্ডে ২২ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে সিপাহী পদে যোগদান করেছিলেন। সেনাদের মধ্যে সবাই মঙ্গল পান্ডে কে খুবই ভালবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন।
তার উপরে সম্পূর্ণ রূপে ভরসা করতে পারতেন। কারণ মঙ্গল পান্ডে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ডিউটি ছাড়াও বাকিটা সময় পূজা অর্চনার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দিতেন। সকলের সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করতেন, সেই কারণে সকলের মনের মধ্যে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন খুবই সহজে।
সিপাহী বিদ্রোহ তে মঙ্গল পান্ডের ভূমিকা:
ভারতের সিপাহী বিদ্রোহ অথবা জাতীয় মহা বিদ্রোহের নাম সকলে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। মঙ্গল পান্ডের মাধ্যমে কলিকাতার উপকণ্ঠে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে এই বিদ্রোহ শুরু। ময়দানে ১৮৫৭ সালের ২৯ শে মার্চ উপমহাদেশের প্রথম ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন সিপাহী মঙ্গল পান্ডে।
এরপর ১৮৫৭ সালের ২৯ শে মার্চের বিকেল বেলায় ৩৪ তম বেঙ্গলী নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি এর সেনাপতির সহকারী লেফটেন্যান্ট বৌগ জানেন যে ব্যারাকপুরে অবস্থিত তার রেজিমেন্টের বেশ কয়েকজন সিপাহী উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছে।
তাছাড়া আরো জানা গিয়েছে যে, তাদের মধ্যে মঙ্গল পান্ডে নামে একজন গাদা বন্ধুকে সশস্ত্র প্যারেড ময়দানে রেজিমেন্টের প্রহরী পক্ষের সামনে রয়েছেন। যিনি সিপাহীদের বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং প্রথম একজন ইউরোপীয় কে গুলি করার হুমকি দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে তদন্তের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণের রেকর্ড করা হয়েছে যে, ভাং পান করার ফলে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাণ্ডে সিপাহীদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং অস্ত্র আটক করেছিল এবং ব্যারাকপুর সেনানিবাসের কাছাকাছি একটি স্টিমারে আগত ব্রিটিশ সৈন্যদের অবতরণের খবর পেয়ে কোয়ার্টার গার্ড ভবনের দৌড়ে গিয়েছিলেন।
এরপর মঙ্গল পান্ডে ৩৪ তম কোয়ার্টার গার্ডের সামনে থাকা স্টেশন বন্দুকের পিছনে অবস্থান নিয়ে নেন এবং বাগ কে লক্ষ্য করে গুলি চালান। তবে পান্ডে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তার ছোঁড়া গুলি বাগের ঘোড়াকে আহত করেছিল আর সেই কারণে ঘোড়াটি বাগকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। খুবই দ্রুত গতিতে নিজেকে রক্ষা করে এবং একটি পিস্তল নিয়ে গুলি করতে করতে পান্ডের দিকে এগিয়ে যান।
তবে তিনিও কিন্তু মঙ্গল পান্ডে কে গুলি করতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন। বাগ তার তলোয়ার বের করার আগেই মঙ্গল পান্ডে তাকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করেছিলেন এবং সেনাপতি সরকারের কাছাকাছি গিয়ে বাগের কাঁধে ও ঘাড়ে তলোয়ার এর আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দেন।
এরপর মঙ্গল পান্ডে কে গ্রেপ্তার করার জন্য হিউশন নামে একজন ব্রিটিশ সার্জেন্ট মেজর কোয়ার্টার গার্ডের কমান্ডার ভারতীয় কর্মকর্তা জিমাদার ঈশ্বরী প্রসাদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশে জিমাদার জানিয়েছিলেন তার এনশিওরা সাহায্যের জন্য গিয়েছে এবং তিনি একা মঙ্গল পান্ডে কে নিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে সিপাহীরা তাদের দিকে গুলি চালাবে আর ঠিক তাই হলো, মঙ্গল পান্ডে তখনই কিন্তু গুলি চালিয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মঙ্গল পান্ডে যখন ধরা পড়ে গেলেন তখন নিজের বন্দুকের সাহায্যে তিনি গুলি করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি তার রেজিমেন্টাল জ্যাকেট জ্বালিয়ে রক্তক্ষরণের মাটিতে লুকিয়ে পড়েন, তবে মারাত্মকভাবে তিনি আহত হননি।
মঙ্গল পান্ডের বিচার এবং ফাঁসি:
আহত অবস্থায় মঙ্গল পান্ডে কে উদ্ধার করা হয়। তারপর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে বিচারের মধ্যে আনা হয়েছিল। বিদ্রোহ চলাকালীন তিনি কোন নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রভাবে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে মঙ্গল পান্ডে বলেছিলেন যে, তিনি নিজেই বিদ্রোহ করেছেন এবং তাকে উৎসাহিত করতে অন্য কোন ব্যক্তি অথবা কোন জিনিসের ভূমিকা তিনি গ্রহন করেননি।
বিচারের রায় হিসেবে জিমাদার ঈশ্বরী প্রসাদ সহ মঙ্গল পান্ডে কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। যদিও কোয়ার্টার গার্ডের তিনজন শিখ সদস্য মঙ্গল পান্ডে কে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তবুও এত কিছুর পর মঙ্গল পান্ডে কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে এমন তারিখও কিন্তু ঠিক হয়ে যায়। নির্ধারিত তারিখের ১০ দিন আগে ১৮৫৭ সালের ৮ ই এপ্রিল প্রকাশ্যে মঙ্গল পান্ডের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ অফিসারদের আদেশ অমান্য করে মঙ্গল পান্ডে কে নিবৃত্ত না করার জন্য একুশে এপ্রিল জিমাদার ঈশ্বরী প্রসাদকে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
মঙ্গল পান্ডের সম্মাননা:
তাঁর স্মৃতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালের ভারতীয় ডাকটিকিতে মঙ্গল পান্ডের ছবি দেওয়া ছিল। যার মধ্য দিয়ে ভারতবাসী মঙ্গল পান্ডেকে সব সময়ের জন্য স্মরণ করে রাখতে পারতেন। দিল্লি ভিত্তিক শিল্পী সি আর পাকরাশি ডাকটিকিট এবং এর প্রচ্ছদ নকশা করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর সেনানিবাসে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সড়কে মঙ্গল পান্ডের স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়। যে জায়গাতে পান্ডে অর্থাৎ মঙ্গল পান্ডে আক্রমণ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তার স্মরণ করার উদ্দেশ্যে শহীদ মঙ্গল পান্ডে মহা উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যারাকপুর সেনা ক্যাম্প এলাকায় তার একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যা সাধারণত মঙ্গল পান্ডে বাগান নামে পরিচিত।
মঙ্গল পান্ডের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র, মঞ্চ এবং সাহিত্য:
মঙ্গল পান্ডে: দ্য রাইজিং এই শিরোনাম দিয়ে বিদ্রোহের ঘটনাবলীর ক্রমভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রে কেতন মেহতার পরিচালনায় মঙ্গল পান্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভারতীয় অভিনেতা আমির খান। যে চলচ্চিত্রটি ২০০২ সালে ১২ ই আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটি মঙ্গল পান্ডের চরিত্রটি সম্পূর্ণ রূপে ফুটিয়ে তুলেছিল। আপনি চাইলে চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন।
দ্যা রোটি রিভিলিয়ন নামে মঙ্গল পান্ডের জীবনী মূলক মঞ্চ নাটকটি রচনা ও পরিচালনা করেছিলেন সুপ্রিয়া করুনাকরন। এরপর স্পর্শ নাট্যদল পরিচালিত নাটকটি ২০০৫ সালের জুন মাসে হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্রপ্রদেশ, অন্ধ্র সরস্বত পরিষদের দ্যা মুভিং থিয়েটারে পরিবেশিত হয়েছিল। যা ছিল সত্যিই রোমাঞ্চকরে ভরা।
তখনকার সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুবকরা একসাথে চাকরি করতো এবং হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে এই যে সম্প্রীতি ছিল খুবই সুন্দর। আর হিন্দু ও মুসলিমের এই সম্প্রীতি ব্রিটিশদের অন্যতম ভায়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাই তারা এই সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য সব সময়ের জন্য চেষ্টা চালিয়ে থাকতো। প্রায় সকল ক্ষেত্রে সহ্য করতে হচ্ছিল ভারতীয় সৈন্যদের সমস্ত রকম অপমান। কিন্তু এমন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য মানুষ কোথায় ? এই অবস্থায় এগিয়ে এসেছিলেন ২৬ বছর বয়সী যুবক মঙ্গল পান্ডে।
হিন্দু মুসলিমের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য রাইফেলের যে কার্তুজ লোড করা হতো তার সামনের অংশটা দাঁত দিয়ে ছিড়ে বন্ধুকে ভর্তি হত। আর এক্ষেত্রে মঙ্গল পান্ডেরা জানতে পারেন যে, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে কার্তুজ গুলো গরুর ও শূকরের চর্বি দিয়ে বানানো হয়েছে। যাতে সবাই কিনা ধর্মভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাতে বিহ্বল হয়ে পড়বে। আর এই বিষয়টি হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতি নষ্ট করতে সাহায্য করবে।
একজন কৃষক পরিবারের জন্মগ্রহণ করা সাধারণ ছোট্ট শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন কে বেছে না নিয়ে খুবই অল্প বয়স থেকেই দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে সিপাহী পদে যোগদান করা, তারপর দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা।
এরপর ব্রিটিশদের সাথে বিদ্রোহ করার মধ্যে দিয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। আর ধরা পড়ার পরে ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবনটাকে বলিদান দিয়ে দেন। এমনই একজন দেশ প্রেমিক, বিপ্লবী মঙ্গল পান্ডে সকলের মনে আজও বেঁচে রয়েছেন।