শিশির কুমার ঘোষ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? শিশির কুমার ঘোষ কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও শিশির কুমার ঘোষের সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Sisir Kumar Ghosh in Bengali)।
শিশির কুমার ঘোষ একজন সুসাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মনীষী শিশির কুমার ঘোষ ১৮৪০ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার, পালুয়া মাগুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিলো তখনকার সময়ে যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহাকুমার কোট চাঁদপুর থানার জয়দিয়া গ্রামে।
প্রপিতামহ রাম রাম ঘোষ ঝিকরগাছার পালুয়া মাগুরার মজুমদার পরিবারের সাথে বৈবাহিক এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক জড়িয়ে পড়েন এবং পলুয়া আর মাগুরায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শিশির কুমার ঘোষ এর জীবনী সম্পর্কে জানা যাক:
- সম্পূর্ণ নাম: শিশির কুমার ঘোষ
- জন্ম: ১৮৪০ সাল
- পিতার নাম: হরনারায়ণ ঘোষ
- মাতার নাম: অমৃতময়ী দেবী
- প্রথম স্ত্রীর নাম: ভুবন মোহিনী দেবী
- দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম: কুমুদিনী দেবী
- জাতীয়তা: তিনি ভারতীয়
- পেশা: তিনি সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক
- মৃত্যু: ১৯১১ সালের ১০ই জানুয়ারি
শিশির কুমার ঘোষের শিক্ষা জীবন:
শিশির কুমার ঘোষ যশোর জেলা স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করার পর কলকাতা কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল, বর্তমান যেটা হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত সেখানে ভর্তি হন।
১৮৫৭ সালে সেখান থেকেই তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন। পরবর্তীকালে তিনি কিছুদিন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করে আবার নিজের গ্রামে ফিরে এসেছিলেন।
শিশির কুমার ঘোষ এর কর্মজীবন এবং সাংবাদিকতা:
কর্মজীবন অনুসারে শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর অফ স্কুল পদে চাকরির মধ্যে দিয়েই তিনি তার কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন। তারপর সাংবাদিকতা অনুসারে ছাত্রজীবন থেকে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করার মধ্যে দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুভ সূচনা হয়।
১৮৬২ সালে তিনি কলকাতার একটি বিধবা মহিলার কাছ থেকে ৩২ টাকায় বেলেইন প্রেস নামক কাঠ দ্বারা তৈরি একটি মুদ্রাযন্ত্র কিনে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা শুরু করেন। এই মুদ্রন যন্ত্রের নামকরণ করেন অমৃত প্রবাহিণী যন্ত্র। প্রথম দিকে এখান থেকে কিন্তু প্রকাশিত করা হতো সাহিত্য, বিজ্ঞান, কৃষি বিষয়ক, শিল্প। এই সমস্ত পত্রিকা ১৮৬২ সালে এর পরিপূর্ণতার রূপ লাভ করে অমৃত প্রবাহিনীর পত্রিকাটি প্রকাশ পায়।
তারপর এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নিজের গ্রামে একটা বাজার স্থাপন করে মায়ের নামে সেই বাজারটির নামকরণ করা হয় অমৃতবাজার, এই বাজারের নামেই তিনি অমৃত প্রবাহী যন্ত্র দিয়ে ১৮৬৮ সালের প্রকাশ করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষের বাংলা সাহিত্যিক মুখপাত্র আনন্দবাজার পত্রিকা।
তখনকার সময়ে এই পত্রিকার বছরের মূল্য ছিল ৫ টাকা। পরবর্তীকালে পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষাতেও প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৯১ সাল থেকে পত্রিকাটি ইংরেজিতেই নিয়মিত ভাবে প্রকাশ হতে থাকে।
কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের সমস্যা, জটিলতা দেখা দিতে থাকে। শিশির কুমার ঘোষ কলকাতার একটি প্রেস থেকে ছাপার কালি তৈরিসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকেন এবং কিছু যুবককেও এই ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসেন এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য।
সমাজ সংস্কারক শিশির কুমার ঘোষ:
সমাজের উন্নতি সাধনে অনেকেই এগিয়ে আসেন, কোন কিছুর স্বার্থ ছাড়াই। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও শিশির কুমার কোষের অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে যে বিধবা বিবাহ চালু করা হয়েছিল, তার স্বপক্ষে তিনি কিন্তু কলম ধরেছিলেন, এবং তিনি পত্রিকাতে লিখেছিলেন যে:-
শিশির কুমার ঘোষের ব্যক্তিগত জীবন:
শিশির কুমার ঘোষ যশোর জেলার খাজুরার গুরুচরণ মিত্রের কন্যা ভুবন মোহিনী কে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে খুবই কম সময়ের মধ্যে।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ৭ বছর পর নদীয়া জেলার হাঁসখালি গ্রামের রামধন বিশ্বাসের কন্যা, কুমুদিনী দেবীকে দ্বিতীয় বারের মতো বিবাহ করেছিলেন।
নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে শিশির কুমার ঘোষের লেখা:
১৮৭৪ সালে মহাত্মা গান্ধীর শিশির কুমার ঘোষ তার পত্রিকায় নীল বিদ্রোহকে বাংলাদেশের প্রথম বিপ্লব বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এর প্রতিকারের স্বপক্ষে লেখা দ্বারা জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়। এই পত্রিকাটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
শিশির কুমার ঘোষের সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা তে ইংরেজ সরকার ও কিন্তু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ইংরেজ সরকার তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে এ সমস্ত বন্ধ করতে বলেছিল। কিন্তু শিশির কুমার ঘোষ এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে,
তার এই ধরনের মানসিকতার কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারের টার্গেটে পড়ে যান এবং ১৮৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়, মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, আর একজন সাংবাদিকের ক্ষমতা কতখানি, সেটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। আর সেই কারণে তার উদ্যোগে ১৮৭৫ সালে গঠিত হয় “ইন্ডিয়া লীগ”।
শিশির কুমার ঘোষ এর সাহিত্য চর্চা:
প্রতিটি মনীষী তাদের কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবন এবং আরো অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, সাহিত্যচর্চা এ সমস্ত বিষয়ে খুবই বেশি গুরুত্ব দিতেন। সমস্ত দিক থেকে জ্ঞান অর্জন করতে কোনরকম সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ঘোষ নাট্যচর্চা, সাহিত্য চর্চা তে বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। বঙ্গীয় নাট্যশালা স্থাপনে তার অবদান কিন্তু বিশেষভাবে স্মরণীয়।
১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৭৪ সালে তার রচিত প্রহসন নাটক বাজারের লড়াই ও নয়শ রুপিয়া এই নাটক দুটি তার পরিচালনায় মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অর্থাৎ অভিনীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি শ্রী অমিয় নিমাই চরিত্র সঠিক খণ্ডে যেটা প্রকাশিত হয়েছে সেটা ইংরেজিতে Lord Gouranga Ges ও Salvation for All গ্রন্থ দুটি রচনা করেন।
শিশির কুমার ঘোষ এর প্রকাশিত গ্রন্থ:
তিনি যেহেতু একজন কৃতিমান লেখক ছিলেন, তার সাথে সাথে ছিলেন সাংবাদিক, তাই তার প্রকাশিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো কালাচাঁদ গীতি (কাব্য), শ্রী নিমাই সন্ন্যাস (নাটক), সর্পগাতের চিকিৎসা এবং সংগীত শাস্ত্র।
এছাড়া তিনি ধর্মানুরাগী হয়ে শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, শ্রী শ্রী গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, হিন্দু স্পিরিচুয়াল ম্যাগাজিন, এই সমস্ত গ্রন্থগুলি প্রকাশিত করেছিলেন।
শিশির কুমার ঘোষ এর মৃত্যু:
একজন সাহসী সাংবাদিক, লেখক এবং সাহিত্যবিদ বাঙালি, নবজাগরণের পথিক শিশির কুমার ঘোষ ১৯১১ সালের ১০ই জানুয়ারি ৭২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর তার অবর্তমানে অমৃতবাজার পত্রিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তার ছোট ভাই মতিলাল ঘোষ। তিনি সমস্ত দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে দাদার এই পত্রিকার দায়িত্বভার সামলেছেন। পরবর্তীকালে পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
সবশেষে বলা যায় যে, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে শিশির কুমার ঘোষের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহ চালু করার পক্ষে যে অল্প কয়েকজন মনীষী ছিলেন তাদের মধ্যে শিশির কুমার ঘোষ ছিলেন অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বিধবা বিবাহ এর স্বপক্ষে তিনি অমৃতবাজার পত্রিকায় খুবই সাহসের সাথে লিখেছিলেন বিধবা বিবাহ নিয়ে। সমাজ সংস্কারক হিসেবে সামাজিক সহযোগিতার অবদানের জন্য তাকে “মহাত্মা” বলে ও ডাকা হতো।
কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবন, সাহিত্যিক জীবন, সাংবাদিকতার জীবন, সমস্ত দায়িত্ব পালন করার মধ্যে দিয়েও তিনি সমাজ সংস্কারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে সমাজের সবথেকে যেটা তখনকার দিনে জটিল বিষয় ছিল বিধবা বিবাহ, তা নিয়েও তিনি কিন্তু ভেবেছিলেন এবং তার পত্রিকাতে প্রকাশ করেছিলেন। এমন মনীষীদের অবদান সত্যিই ভোলার নয়। এদের জন্য সমাজে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটেছে, উন্নতি ঘটেছে। আর সেই কারণেই তো তাঁরা চিরকাল দেশবাসীর মনে অমর হয়ে রয়ে গেছেন।