সারা বছর ক্যালেন্ডার অনুসারে অনেক নবমী তিথি আসে ঠিকই, তবে শারদীয়ার দুর্গোৎসবের এই মহানবমীর দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনে মা দুর্গার আরাধনা করা হলে সমস্ত খারাপ কাজ দূর হয় এবং দেবী দুর্গা তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ প্রদান করেন।
শারদীয়ার নবম দিনে মা সিদ্ধিদাত্রীর পূজা করা হয়। সিদ্ধিদাত্রী দেবী নামের অর্থ হলো সিদ্ধিদানকারী দেবী। মহানবমীর দিনকে পূর্ণ আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে পূজা অর্চনা করা হয়।
এই শুভ দিনে যজ্ঞ ও কন্যা পূজার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পবিত্র শারদীয়া দুর্গোৎসব। তবে এই কন্যা পূজা অর্থাৎ কুমারী পূজা অনেক জায়গায় অষ্টমী তিথিতেও হয়ে যায়। শারদীয়াতে মহানবমীর এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এমনটা বিশ্বাস করা হয় দেবী দুর্গার আশীর্বাদ এই দিন বিশেষভাবে ভক্তদের উপরে বর্ষিত হয়।
তবে সেই সঙ্গে কিছু সামান্য ভুলের কারণেও মা দুর্গা এই দিনে প্রচণ্ড ভাবে রুষ্ঠ হন এবং ভক্তদের উপরে নেমে আসতে পারে দুর্যোগ। তাই এই শুভ দিনে এমন কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে সেগুলি এড়িয়ে চলতে হবে অবশ্যই।
মহানবমীর দিন যে কাজগুলি ভুলেও করবেন না
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, মহানবমীর দিন যে কাজগুলি ভুলেও করবেন না, সেগুলি সম্পর্কে:
- মহানবমীর এই শুভদিনে বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমানো যাবে না ও ব্রহ্ম মুহূর্ত অর্থাৎ সূর্য উদয়ের আগে আপনাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
- খুব ভোরে স্নান করে দেবী দুর্গার নাম জপ করতে হবে।
- ব্রত না রাখতে পারলেও তাড়াতাড়ি স্নান করে পূজা করতে হবে।
- মহানবমীর দিন কোনরকম অশুভ রঙের পোশাক পরা যাবে না, যেমন ধরুন নীল, কালো এই ধরনের রঙের কোন পোশাক পরা যাবে না।
- এই দিনে বেগুনি অথবা বেগুনি রংয়ের যে কোন পোশাক পরা শুভ বলে মনে করা হয়। এই রং মা সিদ্ধিদাত্রীর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
- এই রঙের পোশাক পরে মায়ের পূজা করতে পারেন, এতে দেবী সন্তুষ্ট হবেন।
- সম্পূর্ণ শরীর ও মন দিয়ে মা সিদ্ধিদাত্রীর পূজা করা উচিত, পূর্ণ ভক্তি সহকারে দুর্গা চালিশা ও দুর্গা সপ্তশতী পাঠ করুন।
- এই সময় মনকে সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ রাখতে হবে এবং সেখানে অন্য কোন চিন্তাভাবনা রাখলে হবে না।
- পূজার সময় কারো সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়।
- মহানবমীর দিন যজ্ঞ, পূজা করতে হবে। এটি ছাড়া শারদীয়ার পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়।
- যজ্ঞের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, যেন যজ্ঞের সামগ্রী যজ্ঞ কুন্ডের বাইরে না পড়ে।
- নবমীর দিনে কোন নতুন কাজ শুরু করা নিষিদ্ধ রয়েছে শাস্ত্র অনুসারে।
- বিশ্বাস অনুসারে জানা যায় নবমী একটি তিথি, এর মানে হল এই দিনে করা কোন কাজে সফলতা নেই।
- মহানবমীতে লাউ খাওয়া উচিত নয়।
- অষ্টমীতে উপবাস থাকলে মহানবমীর দিনে পুডিং পুরি ও ছোলা দিয়ে উপবাস ভাঙতে হবে।
- নবরাত্রির নয় দিনে আমিষ খাবার একেবারে গ্রহণ করা যাবে না।
- এই সময় বাড়িতে কোন রকম আমিষ রান্নাও করা যাবে না।
- এই সময় মদ, সিগারেট এবং অন্য কোন রকমের নেশা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মহানবমীর দিন চামড়ার যে কোন জিনিস ব্যবহার করা শাস্ত্রমতে নিষেধ। চামড়ার জুতো, চটি, ব্যাগ, পার্স, বেল্ট, একেবারেই ব্যবহার করবেন না।
- এই সময় কোন খেলাধুলার পোশাক পরা উচিত নয় এর ফলে দেবী রুষ্ট হতে পারেন।
- এছাড়া নবরাত্রীর সময় খেয়াল রাখবেন যেন খাবারের অপচয় না হয়, খাবার বেশি হলে তা নষ্ট না করে টাটকা থাকা অবস্থায় দরিদ্র ব্যক্তি বা গরুকে খাইয়ে দিতে পারেন।
- পাঁচ বছরের কম বয়সী ছেলে মেয়ে, অসুস্থ মানুষ, এবং গর্ভবতী মহিলাদের নবরাত্রীর ব্রত পালনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সম্পূর্ণরূপে।
- হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে কোন ব্রত বা পূজা অর্চনার সময়ে নখ, চুল কাটা উচিত নয়। এই নয় দিনও চুল, দাড়ি, নখ কাটা নিষেধ।
- নবরাত্রিতে দিনের বেলায় ঘুমানো উচিত নয়।
✨ মহানবমীতে এইভাবে দূর হবে সমস্ত রোগ, দুঃখ, কষ্ট:
নবমী তিথি শারদীয়া দুর্গোৎসবের দুর্গা পূজার শেষ দিন বলা যেতে পারে। এই দিন বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চললে দেবীর আশীর্বাদ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি শাস্ত্রে এমন কিছু উপায়ের কথা বলা হয়েছে যা পালন করলে দূর্গা ও তাঁর আরেক রূপ সিদ্ধিদাত্রীর আশীর্বাদ লাভ করা যায়। যে রূপের পূজা করা হয় মহানবমিতে।
কি কি উপায় করবেন সে সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না।
✨ ১) জাফরান, চন্দনের আতর ও গাওয়া ঘি:
মহানবমীর পূজা, পূজা উপকরণে আরো অন্যান্য উপকরণের পাশাপাশি সিদ্ধিদাত্রীকে প্রসন্ন করার জন্য এই শুভদিনে জাফরান, চন্দনের আতর ও গাওয়া ঘি এই তিনটি জিনিস মিলিয়ে পান পাতায় স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে নিন। এরপরে পান পাতায় একটি সুপারি রেখে মৌলি সুতো বেঁধে দিন।
✨ ২) সিঙ্গারের জিনিস, পদ্মফুল, লাল ওড়নাতে কয়েন:
দুর্গাপূজার সিঙ্গারের জিনিস অর্পণ করুন, মহানবমীর দিনে নিয়ম মেনে দুর্গা পূজার পর সিঙ্গারের জিনিস বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে বিতরণ করে দিন। দূর্গা মন্দিরে গিয়ে আটটি পদ্মফুল তার চরণে অর্পণ করুন।
এর পাশাপাশি লাল রঙের ওড়নাতে কিছু কয়েন, মাখানা ও বাতাসা রেখে সেই ওড়নাটি দুর্গার কোলে রেখে দিন। এর ফলে মনে করা হয় দুর্গার বিশেষ আশীর্বাদ বর্ষিত হয় ভক্তের উপরে।
✨ ৩) অর্থসংকট থেকে মুক্তি পেতে:
আর্থিক উন্নতি চান সকলেই, অর্থ সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গঙ্গাজল দিয়ে দুর্গাকে স্নান করান।এরপর নিয়ম মেনে দুর্গা পূজা করুন এবং দুর্গা রক্ষাকবচ পাঠ করতে পারেন। এই নবমী দিনে দু পুজোর সময় হলুদ রঙের কড়ি ও শঙ্খের পূজা করা ও বিশেষ ফলদায়ী বলে মনে করা হয়।
এছাড়াও শাস্ত্র অনুসারে মা লক্ষ্মী প্রসন্ন হন এই কাজ গুলির মধ্যে দিয়ে ও সমস্ত আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।
✨ ৪) আগ্নেয় কোণ এ দুর্গা নামের প্রদীপ জ্বালান:
নবমী তিথি তে বাড়ির আগ্নেয় কোণে দুর্গার নামের প্রদীপ প্রজ্বলিত করতে পারেন। এর পাশাপাশি জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী মহানবমীর দিনে দুর্গা সপ্তশতীর উত্তম চরত্রের পাঠ করুন। দুর্গার আশীর্বাদে ব্যক্তির ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধি পাবে উত্তরোত্তর।
দুর্গাপূজার দিন গুলিতে কোন দিন কোন পোশাক পরবেন? চলুন জানা যাক
✨ নবরাত্রি তে যে কাজ গুলি করলে শুভ ফল লাভ করতে পারবেন:
✨ ১) নবরাত্রির এই নবম দিনে অর্থাৎ মহানবমীতে ঘরবাড়ি পরিষ্কারের পাশাপাশি শারীরিক পরিচ্ছন্নতার খেয়াল রাখা উচিত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠুন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্নান সেরে ফেলুন, তারপর পরিষ্কার পোশাক পরে দেবীর পূজা অর্চনা করতে পারেন।
✨ ২) এই শুভ তিথিতে নিজের আচরণ ঠিক রাখা প্রয়োজন। যেমন ধরুন রাগ, হিংসা, লোভ, আসক্তি, লালসা, মিথ্যাচারের মতো নেতিবাচক আচরণ থেকে দূরে থাকা উচিত। মনের মধ্যে যেন কোনো রকম খারাপ চিন্তা ভাবনা না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে নিজেকেই।
✨ ৩) রান্না করার সময় সরষের তেল ব্যবহার না করে এই সময় বাদাম তেলের ব্যবহার করা খুবই শুভ বলে মনে করা হয়।
✨ ৪) মহানবমীতে মা দুর্গার নবমতম রূপের অর্থাৎ সিদ্ধিদাত্রীর পূজা করা উচিত একাগ্র চিত্তে।
⭐ শরৎকালের হিমেল হাওয়ার পাশাপাশি চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ আর ঢাকের শব্দ সবকিছু মিলিয়ে মনটাকে জুড়িয়ে দেয়। শরৎকালে যে সময় বাঙালিরা শারদীয়া দুর্গাপূজায় মেতে ওঠেন সেই সময় অবাঙালি সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ উদযাপন করেন শারদীয়া নবরাত্রি।
তবে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গোৎসব ও অন্যান্য রাজ্যের নবরাত্রির উদ্দেশ্য কিন্তু একই, দেবী দুর্গার আরাধনা করা। তবে এই কয়দিন চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নিয়ম, পূজা-অর্চনা, এবং তার মধ্যে ভক্তদের মেনে চলতে হয় অনেক বিধি নিষেধ।
যেগুলি মানার ফলে জীবনে আসে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সেগুলির না মানার কারণে জীবনে অনেক বিপদও আসতে পারে, রুষ্ট হতে পারেন দেবী। মহানবমীতে সিদ্ধিদাত্রির উপাসনা করার পাশাপাশি এমন কিছু কাজ আপনি কখনোই করবেন না, যা উপরে আলোচনা করা হলো। সমস্ত নিয়ম মেনে দেবীর উপাসনা করার সাথে সাথে বিধি নিষেধ গুলি মেনে চলুন যার ফলস্বরূপ আপনি পেতে পারেন মায়ের আশীর্বাদ।